আপত্তি: মির্যা সাহেব কেন হজ্জ করেন নি


আপত্তিঃ মির্যা সাহেব কেন হজ্জ করেন নি। অথচ মুসলিম শরীফে আছেপ্রতিশ্রুত মসীহ হজ্জ করবেন।

জবাবঃ অন্যান্য আপত্তিগুলোর মতোই এটিও সম্পূর্ণ একটি অজ্ঞতামূলক আপত্তি। কেউ একজন হযরত মির্যা সাহেবকে মৌলভীদের এই আপত্তি তুলে ধরে বলেন, মির্যা সাহেব আপনি কেন হজ্ব করতে যাচ্ছেন না? তখন তিনি সেই প্রশ্নকারীকে খুবই সুন্দর ও যুক্তিযুক্ত একটি উত্তর প্রদান করেন যা এখানে তুলে ধরছি।

এইসব লোক শত্রুতাবশতই এহেন আপত্তি তুলে। হযরত মোহাম্মদ (সা.) দশ বছর মদীনায় অবস্থান করেন। মক্কা ও মদীনার মধ্যে দূরত্ব মাত্র দুই দিনের ছিল। কিন্তু তিনি (সা.) এই দশ বছরে কোন হজ্জই করেন নি। অথচ তিনি তো বাহন সহ অন্যান্য সকল ব্যবস্থাই করতে পারতেন। কিন্তু হজ্জের জন্য কেবল এই শর্তই প্রযোজ্য নয় মানুষের নিকট হজ্জে যাওয়ার জন্য প্রচুর অর্থ রয়েছে বরং এটাও আবশ্যক কোন ধরণের বিপদ ও বিশৃংখলার আশংকা যেন না থাকে। সেখান পর্যন্ত পৌঁছা এবং নিরাপদে হজ্জ সম্পন্ন করার ব্যবস্থাও যেন উপস্থিত থাকে। যখন পশুস্বভাব সম্পন্ন মৌলভীরা এখানে আমাদের উপর হত্যা করার ফতোয়া প্রদান করে রেখেছে এবং সরকারকেও তারা ভয় করছে না এমতাবস্থায় সেখানে তারা কিবা না করবে। আসলে এসব লোকদের আকাঙ্খাই হচ্ছেআমরা যেন হজ্জ না করি। যদি আমরা হজ্জ আদায় করি তাহলে কি তারা আমাদেরকে মুসলমান মনে করবেএবং আমাদের জামাতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেঠিক আছেপ্রথমতঃ এই সব মুসলমান ওলামা একটি অঙ্গীকারনামা লিখে দিকযদি আমরা হজ্জ করে আসি তাহলে তারা সবাই আমাদের হাতে তওবা করে আমাদের জামাতে প্রবেশ করবে এবং আমাদের মুরীদ হয়ে যাবে। যদি তারা এরূপ লিখে দেয় এবং অঙ্গীকারনামা প্রদান করে তাহলে আমরা হজ্জ করে আসব। আল্লাহ তালা আমাদের জন্য সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করে দিক যাতে করে ভবিষ্যতে মৌলভীদের সকল শত্রুতার অবসান হয়। অনাধিকার করে শত্রুতাসুলভ আপত্তি ভাল নয়। তাদের এই আপত্তি আমাদের উপর পড়ছে না বরং হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর উপরই পড়ছে কেননা হযরত মোহাম্মদ (সা.) ও তার জীবনের শেষ বছরেই হজ্জ করেছেন।” (মালফুযাত, খন্ড- ৫ম, পৃষ্ঠা: ২৪৮)

সুতরাং মির্যা সাহেবের হজ্ব না করা নিয়ে যারা আপত্তি করে থাকেন পক্ষান্তরে তারা রাসূল (সা.)-এর উপরই আপত্তি করে থাকেন। কারণ রাসূল (সা.)- এর নিকট সমস্ত প্রকারের সুবিধা থাকা সত্ত্বেও, যোগাযোগ ও বাহনের সজলভ্যতা থাকার সত্ত্বেও দীর্ঘ ১০ বছর মদীনা থেকে মক্কায় হজ্বে যাননি কেবলমাত্র শান্তি, নিরাপত্তার কথা ভেবে, নিজের এবং সাহাবীদের প্রাণহানির আশংকা রয়েছে চিন্তা করেই। কিন্তু যখন আল্লাহ তাকে মক্কা বিজয় দান করেন এবং নিরাপত্তা ও প্রাণহানির আর কোন আশংকা থাকলো না তখন তিনি হজ্ব আদায় করেন আর তাও তাঁর (সা.)-এর জীবনের একেবারে শেষ বছরে দশম হিজরী তথা ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে।

কাবা শরীফকে দর্শন করার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার কষ্ট আর হযরত রাসূলে মাকবুল (সা.)-এর রওজা জিয়ারত না করতে পারার আক্ষেপ ও দুঃখ হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আ.)-এর হৃদয়ে সর্বদাই বিরাজমান ছিল। নীচের ঘটনাটি আমাদের সামনেই সেই চিত্রই তুলে ধরে।

একদিন প্রতিশ্রুত মসীহ (.) অসুস্থ বোধ করছিলেন এবং তাঁর বিছানায় শুয়ে ছিলেন। প্রতিশ্রুত মসীহ্ (.) –এর স্ত্রী হযরত আম্মাজান (রা.) এবং তার পিতা মীর নাসের নওয়াব সাহেব ঘরের এক কোনে বসে পরস্পর কথা বলছিলেন। কথা বলার একপর্যায়ে যখন হজ্জের প্রসঙ্গ আসলহযরত মীর নাসের নওয়াব মাওউদ (.) তাদের আলোচনা শুনছিলেন। প্রতিশ্রুত মসীহ্ (আ.) মক্কার কাবা শরীফ এবং মদিনায় হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর রওজা মোবারক সম্পকে ভাবতে লাগলেন। (উভয়ের প্রতিতার অসাধারণ ভালবাসার বহিঃপ্রকাশের ফলশ্রুতিতে তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। হজ্জ করার জন্য হযরত মসীহ্ মাওউদ (.)-এর যে পরম বাসনা ছিল এবং তাঁর হৃদয়ে যে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিল তাকে তিনি চাপা দিয়ে হযরত মীর নাসের নওয়াব সাহেবকে সম্বোধন করে বলেন, “এটি সত্য এবং এটি আমার অন্তরের অন্তস্থলের চাওয়াআমি কি কখনো হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর রওজা মোবারক দর্শন করতে পারবো?”

আরেকটি বিষয় স্মরণ রাখা দরকার। পবিত্র কুরআন হজ্জ সম্পাদন করার ব্যাপারে কিছু সুনির্দিষ্ট শর্ত জুড়ে দিয়েছে। এগুলো যদি পূর্ণ না হয় তবে কোন মুসলমানের উপরই হজ্ব আবশ্যক নয়। যেহেতু পবিত্র কুরআন সর্বকালের সর্বযুগের জন্য চিরস্থায়ী সংবিধান তাই এই নিয়ম-কানুন, বিধি-নিষেধ আমাদের জন্যও চিরস্থায়ী যার লংঘন কখনোই সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআন আমাদেরকে কি বলছে?

فِيهِ آيَاتٌ بَيِّنَاتٌ مَقَامُ إِبْرَاهِيمَ ۖ وَمَنْ دَخَلَهُ كَانَ آمِنًا ۗ وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا ۚ وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ

অর্থ: আর আল্লাহরই উদ্দেশ্যে এ ঘরের হজ্জ করা মানুষের জন্য ফরয, (অর্থাৎ তাদের জন্য) যারা সে (ঘর) পর্যন্ত যাওয়ার সামর্থ্য রাখে। (সূরা আলে ইমরান: ৯৮)

পবিত্র কুরআনের উপরোক্ত নির্দেশাবলী ও শর্ত যে কোন হজ্ব করার ইচ্ছা পোষণকারী ব্যক্তির জন্যই প্রযোজ্য। হযরত মির্যা সাহেব কোরআনের নির্দেশিত উপরোক্ত নির্দেশনা মানার কারণেই তার পক্ষে হজে গমণ করা সম্ভব হয়ে উঠে নি। কারণ হজ্জ যাত্রা তার জন্য কখনোই নিরাপদ ছিল না। কারণ আহমদীয়া বিরোধী শত্রুরা তাকে হত্যা করার ফতোয়া অনেক আগেই প্রদান করে রেখেছিল। তাই হজ্জ করার পূর্ব শর্ত যাত্রা নিরাপদ হতে হবে পূর্ণ না হওয়ায় তিনি হজ্জে গমন করেন নি।

তবে এর সাথে আরেকটি বিষয় স্মরণ রাখা প্রয়োজন হযরত মির্যা সাহেব নিজে হজ্জে গমন করতে না পারলেও তাঁর পক্ষ থেকে তিনি হজ্বে বদল বা বদলী হজ্ব আদায় করে নিয়েছিলেন যা সুস্পষ্টভাবে শরীয়ত ও হাদীস সমর্থিত। হযরত মির্যা সাহেব তাঁর বিশ্বস্ত ও অনুগত সাহাবী হযরত আহমদউল্লাহ সাহেব (রা.)-কে দিয়ে তাঁর বদলী হজ্ব আদায় করিয়ে নেন।

বাকী থাকল, মুহাম্মদ (সা.) এর ভবিষ্যদ্বানী। হাদিসটি হল, ইবনে মরিয়ম ফাজ্জে রাওহা মাকাম থেকে হজ্জ অথবা উমরাহর জন্য ইহরাম বাধবেন। (মুসনাদ আহমদ) এই হাদিসের মূল উদ্দেশ্য হল, খ্রিষ্টানদেরকে এটি বলা যে, তোমাদের মসীহ বায়তুল্লাহ হজ্জ করবেন। অতএব তোমরা মুহাম্মদ (সা.) এর শরীয়তে ঈমান আন। এই ভবিষ্যদ্বানী রসূলুল্লাহ (সা.) এর যুগেই পূর্ণ হয়ে গেছে। সুতরাং রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রাওহার উপত্যকার পাশে সত্তর জন নবী খালি পায়ে চাদর পরিহিত অবস্থায় খানা কাবার তাওয়াফ করেছেন। এটিই সেই রাওহা স্থান এবং এখানে ঈসা ইবনে মরিয়মও ছিল। (শারহুত তাআররুফ, পৃষ্ঠা ৭)

অন্যান্য উত্তর