আপত্তি: মির্যা সাহেব কেন ছবি তুলেছেন?


আপত্তিঃ মির্যা সাহেব কেন ছবি তুলেছেন? অথচ হাদীসে আছে, ‘প্রত্যেক চিত্রকর/আকৃতিদাতা জাহান্নামী হবে। এর প্রমাণস্বরূপ একটি হাদীস পেশ করে। তা হলো كُلُّ مُصَوِّرٍ فِي النَّارِ يَجْعَلُ لَهُ بِكُلِّ صُورَةٍ صَوَّرَهَا نَفْسًا فَتُعَذِّبُهُ فِي جَهَنَّمَ অর্থ: প্রত্যেক ছবি প্রস্তুতকারী জাহান্নামী হবে। (মুসলিম শরীফ, কিতাবুল লেবাস ওয়ায যায়নাহ (পোশাক ও সৌন্দর্য অধ্যায়) মূল হাদীস নং ৩৯৫২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন হাদীস নং- ৫৩৫৯)

জবাবঃ এখন চলুন প্রথমত আমরা দেখি আল্লাহ নিজে এই সম্পকে কি বলছেন, هُوَ اللَّهُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ অর্থ: তিনিই হচ্ছেন আল্লাহ যিনি সৃষ্টিকর্তা, আদি সুনিপুণ স্রষ্টা এবং সর্বোত্তম আকৃতিদাতা বা চিত্রকর। (সূরা আল হাশর ৫৯ : ২৫) এখন এসব অআহমদী বিরুদ্ধবাদী কি বলবে, একই শব্দ যার আরবী মুসাওয়ের (আকৃতিদাতা) সেটা তো আল্লাহ নিজের জন্যই ব্যবহার করছেন?

মনে হচ্ছে নাউযুবিল্লাহ আল্লাহও তাদের মধ্যেও আছেন যারা নরকে আগুনের শাস্তি পাবে!! এসব বিরুদ্ধবাদীদের মাথায় কি কিছু নেই? আকৃতিদাতা হলেই কি জাহান্নামী হয়ে যাবে?

দ্বিতীয়ত, হযরত সোলায়মান (আ.) সম্পকে পবিত্র কোরআনে এই বর্ণনা এসেছে যে, يَعْمَلُونَ لَهُ مَا يَشَاءُ مِنْ مَحَارِيبَ وَتَمَاثِيلَ وَجِفَانٍ كَالْجَوَابِ وَقُدُورٍ رَاسِيَاتٍ ۚ اعْمَلُوا آلَ دَاوُودَ شُكْرًا ۚ وَقَلِيلٌ مِنْ عِبَادِيَ الشَّكُورُ অর্থ: তারা সোলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাস্কর্য, হাউযসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত। হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতা সহকারে তোমরা কাজ করে যাও। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পসংখ্যকই কৃতজ্ঞ।(সূরা সাবা ৩৪ : ১৪)

এখন এসব বিরুদ্ধবাদী মৌলভী কি বলবে, হযরত সোলায়মান (আ.) যেসব ভাস্কর্য বা মূর্তি বানাতেন তার জন্য তিনি শাস্তি প্রাপ্ত হবেন? সোলায়মান (আ.) এর মতো বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান বাদশাহ কি জানতেন না, এর দ্বারা শিরক (অংশীবাদিতা) বিস্তার লাভ করতে পারে? অথচ নবীদের প্রধান কাজই হচ্ছে, অংশীবাদিতা দূর করা। পবিত্র কোরআনে মানব জীবনের সকল দর্শনেই সর্বোত্তম ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। চিত্রকর হলেই বা কোন কিছুর আকৃতিদাতা হলেই যে তার জন্য দোযখের শাস্তি প্রাপ্ত হতে হবে এতোট ছোট ও হীনমনা ধর্ম নয় ইসলাম।

পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন তাফসীর ও সর্বস্বীকৃত পবিত্র কুরআনের তাফসীর গ্রন্থ ‘তাফসীর-এ-কবীর’ যা হযরত আল্লামা ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী (রহ.) লিখছেন উক্ত তাফসীরের সূরা আল বাকারার ২৪৮-২৪৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ইমাম রাযী (রহ.) বলছেন, قَالَ أَصْحَابُ الْأَخْبَارِ: إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى أَنْزَلَ عَلَى آدَمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ تَابُوتًا فِيهِ صُوَرُ الْأَنْبِيَاءِ مِنْ أَوْلَادِهِ، فَتَوَارَثَهُ أَوْلَادُ آدَمَ إِلَى أَنْ وَصَلَ إِلَى يَعْقُوبَ অর্থ: সংবাদদাতা বললেন, আল্লাহ তা’লা হযরত আদম (আ.)-এর কাছে একটি তাবুত (সিন্ধুক) পাঠিয়েছেলেন যেখানে হযরত আদমের বংশধরে আবির্ভূত সকল নবীর ছবি ছিল। আদমের বংশধররা এটি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয় এবং এটি (সর্বশেষ) ইয়াকুবের নিকট পৌঁছায়। (তফসীর কবির, সূরা আল বাকারা ০২ : ২৪৮-২৪৯)

তাফসীর– বায়যাবী– এ ‘তাবুত’ বা সিন্ধুক সম্পকে এই বর্ণনা এসেছে যে, وقيل صورة الأنبياء من آدم إلى محمد عليهم الصلاة والسلام. وقيل التابوت هو القلب অর্থ: বলা হয় এই সিন্ধুকের মধ্যে হযরত আদম থেকে নিয়ে হযরত মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ড্র সমস্ত নবীগণের ছবি ছিল আবার অনেকে বলেছেন, তাবুত হচ্ছে, হৃদয় বা জ্ঞান। (তাফসীর-ই- বায়যাবী, সূরা আল-বাকারা ২৪৯-২৫০)

আমি আপনাদের সামনে এই দুইটি প্রধান ও স্বনামধন্য তাফসীরের উল্লেখ এই জন্যই করলাম যাতে আপনারা পবিত্র কুরআনে ছবি বা চিত্রকর সম্বন্ধে কি ধারণা পোষণ রাখে তার একটি চিত্র বুঝতে পারেন। তাই বিষয়টি চিন্তা করা দরকার, মূলত হযরত রাসূল (সা.) কোন ধরণের চিত্রকরদের বা আকৃতিদাতাদের জন্য এই শব্দ ব্যবহার করেছেন? ছবি তুললেই কি সে জাহান্নামী হয়ে যাবে কিংবা ছবি তুললেই কি সেই ব্যক্তি শরীয়ত বিরোধি কার্যালাপে লিপ্ত বলে সাব্যস্ত হবে?

মনে রাখুন, রাসূল করিম (সা.) যে ধরণের চিত্রকরদের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা বা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন তা হচ্ছে মূলত রং কলমের মাধ্যমে যে ছবি অংকন করা হয় তার ব্যাপারে। কারণে রঙ পেন্সিলের মাধ্যমে শিল্পী তার মনের মাধুরী মিশিয়ে, নিজস্ব ভাবনার জগতে ছবি অংকন করে থাকে। এই ধরণের ছবি তোলাই হচ্ছে আল্লাহর রাসূল (সা.)-র হাদীসের নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত। এই রকম শিল্পী বা চিত্রকররা যে কি পরিমান মনের আবহ থেকে ছবি অংকন করে তার জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ, গৌতম বুদ্ধ, যীশু, রাম, কনফুসিয়াস অবতার ও ধর্মগুরুদের চিত্রের দ্বারাই প্রমাণিত। আজকের তাঁদের যে চিত্র আমরা দেখতে পাই তার সবগুলোই যে চিত্রকরদের কল্পনারূপ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এগুলো একটিও এসব মনিষীদের আসল ছবি নয়।

তাই চিত্রশিল্পীদের দ্বারা কৃত অধিকত ছবি এবং ফটো (ছবি)-র মাঝে বিশাল একটি পার্থক্য আছে। অঙ্কিত ছবি নিষিদ্ধ কিন্তু ফটো ছবি বৈধ। অংকিত ছবি কোন জিনিসের বাহ্যিক অবয়বকে নিজের মতো করে তুলে ধরে যা মূলত তার অস্তিত্ব বহন করার প্রমাণ দেয়। কিন্তু একটি ফটো বা ছবি কখনো অংকিত ছবির পর্যায়ের ন্যায় নয়। ফটো হচ্ছে সম্পূর্ণ একজন প্রতিবিম্ব যাকে ইংরেজীতে এককথায় reflection বলা যায়। ফটো তুলার মাঝে যেহেতু কোন ধরনের পরিবর্তনের বা বিকৃতির সম্ভাবনা থাকে না এবং ছবিটি হুবহু প্রতিবিম্ব হয়েই আসে তাই এটি বৈধ। এজন্যই আরবীতে ফটোগ্রাফীকে “উক্কাস” বা প্রতিবিম্ব শিল্প বলা হয়। তাই হযরত আবু তালহা (রা.) বর্ণিত একটি একটি হাদীসও এ ব্যাপারে একই মত পোষণ করছে

أَنَّهُ قَالَ ‏ Ò‏ لاَ تَدْخُلُ الْمَلاَئِكَةُ بَيْتًا فِيهِ كَلْبٌ وَلاَ صُورَةٌ ‏Ó‏‏.‏ يُرِيدُ التَّمَاثِيلَ الَّتِي فِيهَا الأَرْوَاحُ অর্থ: যে ঘরে কুকুর এবং (প্রাণীর) ছবি থাকে সে ঘরে ফেরেশতা প্রবেশ করে না। তিনি এমন মূতির দিকে ইঙ্গিত করে এ কথা বলেছেন, যার মধ্যে রূহ (আত্মা) থাকে। (বুখারী শরীফ, কিতাবুল লিবাস (পোষাক অধ্যায়), বাবু লা তাদখুলুল মালায়িকা বায়তান ফিহী সুয়ারে (যে ঘরে ছবি থাকে সে ঘরে ফেরেশেতা প্রবেশ করে না অধ্যায়), হাদীস নং- ৫৬১৫)

আহমদীয়া মুসলিম জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.) কেবলমাত্র এ বিষয়টির দিকেই লক্ষ্য করেই ছবি তুলতে রাজী হয়েছেন। কারণ ফটোগ্রাফী যেহেতু সম্পূর্ণ নিজের প্রতিবিম্ব তাই এতে বিকৃতির আশংকা নাই। তাছাড়া তিনি সেই সব মানুষদের আন্তরিক বাসনা ও ইচ্ছা পূর্ণ করার তাঁকে চাক্ষুষ দেখার সুযোগ লাভ করেন নি।

ইসলামী মৌলবাদীরা ফটোগ্রাফীকে মূর্তিপূজার ধারক ও বাহক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। তারা তখন এমনও কথা বলেছিল, মির্যা সাহেব ভবিষ্যতে নিজের পুজা করার জন্যই ছবি তুলেছেন! কিন্তু হযরত মির্যা সাহেব তাদের এই অবান্তর দাবী , ফতোয়া এবং অভিযোগকে ঘৃনাভরে প্রত্যাখান করেছেন।

হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আ.) -এর ছবির দিকে লক্ষ্য করলেই স্পষ্ট বুঝায় যায়, তিনি (আ.) কি উদ্দেশ্যে ছবি তুলেছেন। তিনি (আ.) যে কয়টি ছবি তুলেছেন এর সবগুলো ছবির দিকে তাকালেই বুঝা যায় এর মধ্যে বিন্দু পরিমাণ পূজা করানোর কোন উদ্দেশ্য ছিল না। রানী ভিক্টোরীয়া সময়কালীন সেই ফটোগ্রাফার যে কিনা হযরত মির্যা সাহেবের ছবি তুলেছেন, তিনি বেশ দক্ষ ও অভিজ্ঞ ফটোগ্রাফার ছিলেন। তিনি ভাল করেই জানতেন কিভাবে ছবি তুললে মির্যা সাহেবের ছবিটি আরও আকর্ষণীয় ও মুগ্ধকর হবে। আর তাই তিনি হযরত আহমদ (আ.)- কে বারবার বলছিলেন, আপনি আপনার চোখকে আরও একটু প্রশস্তভাবে খুলে ক্যামেরার দিকে তাকান যাতে ছবির সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় কিন্তু হযরত আহমদ (আ.) কুরআনী নির্দেশ অনুসারে দৃষ্টি অবনত রাখা সম্পকে অবহিত ছিলেন বিধায় তিনি তাঁর চোখ পুরোপুরি খুলেন নি। ফলশ্রুতিতে ফটোগ্রাফার তাঁকে তার অবস্থানের উপরেই ছেড়ে দেন এবং তিনি যেরূপ ছিলেন সে অবস্থায় ছবি তুলে ফেলেন।

অন্যান্য উত্তর