আমাদের প্রিয় খলীফা হযরত মির্যা মাসরূর আহমদ (আই.)
আমাদের প্রিয় খলীফা হযরত মির্যা মাসরূর আহমদ (আই.)
লেখক: মাওলানা মাহমুদ আহমদ, মিশনারী ইনচার্জ ও আমীর, অষ্ট্রেলিয়া
হুযূর (আই.) এর সাথে লেখক মাওলানা মাহমুদ আহমদ, মিশনারী ইনচার্জ ও আমীর। অষ্ট্রেলিয়া এবং অষ্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্ট সদস্য মি. রজার প্রাইস
আমরা তালিমুল ইসলাম কলেজে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষ এক সাথে পড়েছি। মিয়া সাহেব তখন সকলের চাইতে অনন্য ছিলেন। যেমন গাউন ও টুপি তখন এক রকম আমাদের হাতেই থাকত। কিন্তু হুযুর পুরোপুরি এর পাবন্দী করতেন । তিনি নিয়মিত গাউন ও টুপি পরতেন। আমরা মন্তব্য করতাম যে, কোন সময় টুপি বা গাউন না পরলেও চলে । তিনি বলতেন যে এটাতো কলেজ টাইমে পরার জন্য বলা হয়েছে। এ মন্তব্য করলেন হযরত সাহেবের একজন ক্লাসমেট যিনি বর্তমানে কাষ্টমসে কর্মরত। আল্লাহর ফযলে আমরা খোদ্দামুল আহমদীয়ায় এক সাথে কাজ করেছি। মজলিসে আমেলার মিটিং বাদ মাগরিব শুরু হয়ে এশা পর্যন্ত চলতো। মসজিদ মোবারকে আযানের পরপরই মিটিং শেষ হতো। হযরত সাহেব আযান শুরু হলেই অনুমতি নিয়ে মসজিদ মোবারকে চলে যেতেন। আমরা যদি বলতাম যে, আমরাও নামাযে যাব। তিনি বলতেন,
‘মসজিদে গিয়ে অজু সেরে দু’রাকাত নফল আদায় করা যাবে আর মিটিং তো শেষ হয়েছে। মসজিদে গিয়ে প্রথম সারিতে বসার সওয়াব আছে’
ছোট বেলা হতে আমরা রাবওয়াতে একই সময় বড় হয়েছি। তখন হতে দেখেছি যে, মসজিদে নামায, রোযায় দরস শোনার প্রতি তিনি সহপাঠিদের মধ্যে ভিন্ন ছিলেন। শুনা ও এতায়াত করার ব্যাপারে তার গুণ পরিলক্ষিত হয়। অফিসেও কাজের বেলায় সদা তিনি নিয়মানুবর্তিতা দেখিয়েছেন কোন ব্যাপারে তাকে জেদ করতে দেখিনি । তিনি তার মতামত ব্যক্ত করতেন । তবে তার কথাটি বলবৎ থাকুক, এমন ঘটনা আমার মনে পড়েনি। হযরত সাহেব মোটেই দরবারী টাইপের ছিলেন না। তাঁর মরহুম পিতা মির্যা মনসুর আহমদ সাহেবও দরবারী ছিলেন না। তবে তাঁর এডমিনিষ্ট্রেশনের দক্ষতার ব্যাপারে দ্বিমত নাই। হযরত মির্যা মাসরূর আহমদও তদনুরূপ।
খিলাফত হলো ফুলদানী। বিভিন্ন ফুলের দ্বারা যেমন ফুলদানী সাজান হয়। খিলাফতও তেমনি সময় অনুযায়ী খোদা তাআলা খলীফা নির্বাচনের মাধ্যমে । খিলাফতের সৌন্দর্য প্রকাশ করে থাকেন। এই কারণেই হযরত খলীফা রাবে (রাহে.) তার জুমুআর খুতবাতে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে এক খলীফাকে অন্যের সাথে তুলনা করা ঠিক নয়। বিভিন্ন ফুলের বিভিন্ন সুবাস থাকে।
হযরত সাহেব মূলত: এগ্রিকালচারিষ্ট। তার মানে কৃষিবিদ। তাই পরিশ্রম অর্থাৎ রোদ বৃষ্টিতে কাজ করায় অভ্যস্ত । রাবওয়ার পাশেই তাদের খামার। হযরত খলীফা রাবে যখন খলীফা হন, তখন তাঁর নিজের ও তিনি যে সমস্ত জমি দেখাশুনা করতেন, সে সবের দায়িত্ব মির্যা মাসরূর আহমদ (আই.) কে দেন। হযরত সাহেব কয়েক বৎসর আফ্রিকার ঘানায় শিক্ষকতা করেছেন।
তদুপরি সেখানে জামাতের ফার্মেরও ম্যানেজার ছিলেন। তখন সেখানে গমের চাষে সফল হয়ে তিনি সুনাম অর্জন করেছেন। পানির খুবই অভাব সেখানে। দূর দূরান্ত হতে পান করার পানি বয়ে আনতে হতো। সেটাও তিনি কয়েক বছর করেছেন । পানি যে কত বড় নিয়ামত তা সেখানে গেলে বুঝা যায়। ঘানা সফর কালে, ওয়াতে পৌঁছলে খোদ্দামরা আমাকে বলল যে, এশার পর আমাকে তারা অদ্ভুত এক জিনিষ দেখাবে । তবে রাতে প্রায় হাফ মাইল যেতে হবে। গিয়ে দেখি পানির চাপ কল । তারা বলল এটাতে খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার লোহার একটি হাতলে চাপ দিলে পানের যোগ্য পানি বেরিয়ে আসে।
হযরত সাহেব জামা’তের বিভিন্ন অফিসে কাজ করেছেন আমি যখন ১৯৯১ সালে অষ্ট্রেলিয়া আসি, তখন তিনি তাহরীকে জাদীদের ওসীয়্যত ডিপার্টমেন্টের ইনচার্জ ছিলেন। এই বিভাগটি ওকালতে মাল সানীর অধীনে কাজ করে। পরে তিনি নাযের তালিম পদে অধিষ্ঠিত হন। খলীফা নির্বাচিত হবার সময় তিনি নাযের আলা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অংগসংগঠনে তিনি খোদ্দাম ও আনসারুল্লায় কাজ করেছেন। সর্বত্রই তিনি তার সহকর্মীদের সাথে মিলেমিশে কাজ করার সুন্দর নমুনা দেখিয়েছেন। তবে যে বিষয়টিতে আমাদেরকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছেন তা হলো ইবাদতের প্রতি তার বিশেষ দৃষ্টি আর নিয়মানুবর্তিতা। লায়ালপুর, বর্তমান ফয়সালাবাদ, সেখানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় একবার ছুটিতে রাবওয়াতে যাতায়াতে কোন ব্যঘাত ঘটে। কালক্ষেপন না করে তখনই তিনি বাইসাইকেলে যাত্রা করেন এবং সময়মত ফয়সালাবাদে পৌঁছান।
বায়তুল হুদা, সিডনী অস্ট্রেলিয়া
হযরত খলীফাতুল মসীহ্ অষ্ট্রেলিয়া এসেছেন। তার সাথে আমাদের স্থানীয় এম, পি, অনারেবল রজার প্রাইস্ দেখা করেছেন । হুযুর যেদিন পৌঁছান তার পরের দিনই মি. প্রাইস্ এর বিদেশ যাবার কথা। তাই হুযূর সেদিনই তাকে সাক্ষাত দান করেন। মোলাকাতের সময় ছিল ৩০ মিনিট তবে তা চলেছে ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট। অষ্ট্রেলিয়াতে কৃষির বিভিন্ন দিক নিয়েই বেশি আলোচনা হয়। যেখানেই গিয়েছি, আগেই নামাযের ব্যাপারে হুযুর জিজ্ঞাসা করেছেন কি ব্যবস্থা হবে।
আলহামদুলিল্লাহ্, সকল স্থানেই সময়মত নামায আদায়ের ভাল ব্যবস্থা করা হয়। সিডনি অপেরা হাউস দেখার সময়ও সেখানে নামাযের ব্যবস্থা করা হয়। কাজ সমাধা করার আগে আরাম করার প্রশ্নই উঠে না । ছোট সময় হতেই হুযুরকে এমনটা দেখেছি। হযরত মৌলানা আব্দুর রহীম দর্দ সাহেবের ছেলে মুজিবুর রহমান দর্দ শুনালেন যে,
“আফ্রিকার এক দেশে জামা’তের কাজে কিছু দিন একত্রে থাকার সুযোগ তার হয়েছে । কোন কোন সময় দিনরাত ধরে বেশ করতে হয়েছে। বার লেইট নাইট কাজও করেছি। মিয়া সাহেব নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামায আদায় করেছেন”
পঞ্চম খিলাফতের ইলেকশান হবার একদিন পূর্বে আমি অষ্ট্রেলিয়া হতে লন্ডন পৌছেছি। তার সাথে দেখা করলে তিনি খুবই আদর আপ্যায়ণ করে নিজে চা নাস্তা এনে দেন যে আমি ২২ ঘন্টা সফর করে লন্ডনে পৌঁছেছি। আল্লাহ্ তাঁকে উত্তম জাযা দান করুন এবং আমাদেরকে তাঁর সাথে যথাযথ কাজ করার তৌফিক দান করুন।
ছবিসহ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় – পাক্ষিক আহ্মদী – ৩১শে মে ২০০৯ইং | The Fortnightly Ahmadi – 31st May 2009 | পৃষ্ঠা: ৫২-৫৩