বাংলাদেশে আহ্‌মদীয়াত


“ইতোপূর্বে বাঙ্গালীদের সম্পর্কে যে আদেশ জারি করা হয়েছিল-এখন তাদের মনোতুষ্টি করা হবে”।
ইলহাম হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ) (১৯০৬ সন)

হিমালয়ের পাদদেশে গঙ্গা অববাহিকায় অবস্থিত রংধনুর দেশ বাংলাদেশ। পরিবর্তনশীল ষড়ঋতুর উষ্ণতাপ্রবণ নাতিশীতোষ্ণ এক দেশ বাংলাদেশ। এর পশ্চিম, উত্তর ও পূর্বে ভারত, দক্ষিণ-পূর্বে কিছুটা সীমান্ত জুড়ে মায়ানমার এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত।

সকল ঐশী সম্প্রদায়ের মত বাংলাদেশের আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’তেরও সূচনা খুবই দুর্বল ও বাহ্যিক নিঃস্ব অবস্থায় হয়েছিল। সম্ভবত ১৯০৫ সনের দিকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের একজন খ্যাতনামা ব্যক্তি হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর হাতে বয়’আত গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন আনোয়ারা থানার হযরত আহমদ কবীর নূর মোহাম্মদ সাহেব (রাঃ)। তারপরে ১৯০৬ সনে কিশোরগঞ্জ জেলার নাগেরগাঁও গ্রামের এক স্বনামধন্য ব্যক্তি কাদিয়ান গিয়ে হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর হাতে বয়’আত গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন হযরত রঈস উদ্দিন খাঁন সাহেব (রাঃ)। তাঁর স্ত্রী একখানা লিখিত পত্রের মাধ্যমে হযরত আকদাস মসীহে মাওউদ (আঃ)-এর জীবদ্দশাতেই ১৯০৭ সনে বয়’আত গ্রহণ করেন। রিভিউ অব রিলিজিয়নস এর মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে ১৯০৯ সনে একজন গভীর জ্ঞানসম্পন্ন পন্ডিত ও শিক্ষাবিদ বগুড়া নিবাসী হযরত খাঁন সাহেব মৌলভী মোবারক আলী খাঁন কাদিয়ানে গিয়ে বয়’আত গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯১২ সনের পূর্ব পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের একজন স্বনামধন্য আলেম ও ঋষিপুরুষ খলীফাতুল মসীহ্‌ আউয়ালের কাছে গিয়ে বয়’আত গ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত এখানকার জামা’তের আনুষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপিত হয়নি। এই বুঁযূর্গ ব্যক্তিত্ব ছিলেন হযরত মাওলানা সৈয়দ আব্দুল ওয়াহেদ সাহেব (রহঃ)। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে তাঁর শত-সহস্র অনুসারী ছিল। তিনি দীর্ঘদিন গবেষণা ও অনুসন্ধানের পর আহ্‌মদীয়াত গ্রহণ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, তাঁর অনুসন্ধান মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর জীবদ্দশাতেই শুরু হয়েছিল। তিনি দীর্ঘদিন পর্যন্ত হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ)-এর সাথে পত্র আদান-প্রদান করেন এবং তাঁর এই যোগাযোগের উল্ল্যেখ বারাহীনে আহ্‌মদীয়ার পঞ্চম খন্ডে সংরক্ষিত আছে। যেহেতু তিনি খুবই বিখ্যাত এবং স্বনামধন্য আধ্যাত্মিক পুরুষ ছিলেন তাই তাঁর কাদিয়ান হতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রত্যাবর্তনের সাথে-সাথে সেখানে জামা’তে আহ্‌মদীয়া, বাংলাদেশের কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। সুতরাং ১৯১২ সন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জামা’তে আহ্‌মদীয়া বাংলাদেশের পদচারণা শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ জামা’তের কেন্দ্র রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত এবং সারা দেশব্যাপী এর অনেক মসজিদ ও মিশন হাউস রয়েছে।

আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামা’ত বাংলাদেশ সূচনালগ্ন থেকেই খলীফাতুল মসীহের প্রত্যক্ষ ও সূক্ষ্ম তত্ত্বাবধানে থাকার সৌভাগ্য লাভ করেছে। খিলাফত যখন কাদিয়ানে ছিল এবং পরর্তীতে রাবওয়াতে যাওয়ার পরও বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রোগ্রামে খলীফাতুল মসীহ্‌ বাংলাদেশ জামাতের সদস্যদের তরবিয়তের জন্য সরাসরি নিজের প্রতিনিধি প্রেরণ করেছেন। সবচেয়ে সৌভাগ্যের বিষয় হলো, খলীফাতুল মসীহ্‌ সালেস এবং খলীফাতুল মসীহ্‌ রাবে তাদের খেলাফতের পূর্বে খলীফাতুল মসীহ্‌র পক্ষ থেকে বাংলাদেশ জামা’ত সফর করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে খুব ছোট ব্যাপ্তিতে শুরু হওয়া এই জামা’ত বর্তমানে সমস্ত দেশব্যাপী ১০৩টি শাখায় বিস্তার লাভ করেছে এবং বর্তমানে দেশব্যাপী প্রায় ৪২৫টি এরূপ স্থান রয়েছে যেখানে আহ্‌মদীদের ছোট-ছোট সমাজ বা হালকা রয়েছে। আল্লাহ তা’আলার অশেষ রহমত এই যে, বাংলাদেশ জামা’ত এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বব্যাপী আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাতের প্রচারের জন্য অনেক বুযূর্গ ওয়াকফে জিন্দগী ব্যক্তিত্বের জন্ম দিয়েছে এবং তাঁদের অনেকে এখনও সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এখানকার জামাতের ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণরূপে স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা পরিচালিত।

এই জামাতের সমস্ত কর্মকর্তারা নিজেদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বর্তমানে আমাদের জামাতের ৬৫জন মোবাল্লেগ রয়েছে যারা দিনরাত জামাতের সেবা করে যাচ্ছে এবং তাদের কার্যক্রম কেন্দ্র, রিজিওন ও স্থানীয় পর্যায়ে এই তিনটি স্তরে পরিচালিত হয়। সমস্ত অঙ্গসংগঠনগুলি খোদ্দাম, আনসার ও লাজনা পূর্ণ উদ্যোমে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই জামা’ত ১৯২০ সন থেকে বাংলাদেশের প্রাচীনতম পাক্ষিক পাত্রিকা ‘আহ্‌মদী’ নিয়মিতভাবে বের করে আসছে। অঙ্গসংগঠনসমূহের নিজস্ব ম্যাগাজিন/বুলেটিন রয়েছে। ঢাকাতে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এম.টি.এ. বাংলাদেশ স্টুডিও রয়েছে যা নিয়মিত এম.টি.এ. ইন্টারন্যাশনালের জন্য প্রোগ্রাম তৈরি করে থাকে। অতিসম্প্রতি জামেয়া আহ্‌মদীয়া বাংলাদেশের সাত বছর মেয়াদী শাহেদ কোর্স চালু হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ। বাংলাদেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুন্দরবন, আহমদনগর-শালসিঁড়ি, রাজশাহী, কুমিল্লা এবং জামালপুর-ময়মনসিংহ অঞ্চলে আহ্‌মদীদের সংখ্যা উল্ল্যেখযোগ্য ।

খলীফাতুল মসীহ্‌ আল খামেস (আই:)-এর আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব ও তত্ত্বাবধানে এই জামা’ত এখন বিশেষভাবে তবলীগের ময়দানে কাজ করছে এবং প্রতিদিন নতুন-নতুন ভাই-বোনেরা আহ্‌মদীয়াত গ্রহণ করছে। এছাড়াও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও বিভিন্ন জামাতে মসজিদ ও মোয়াল্লেম কোয়ার্টার তৈরির কাজ অব্যাহত রয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলার সত্য জামাতের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাংলাদেশ জামা’তও সময়ে-সময়ে মোখালেফাতের (বিরোধিতার) শিকার হয়েছে। ১৯৬৩-২০০৩ পর্যন্ত এই জামা’ত সত্যের প্রচারের জন্য আল্লাহ্‌র রাস্তায় ১২ জন ব্যক্তির শহীদ হওয়ার সম্মান প্রাপ্ত হয়েছে। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এই জামা’ত সারা দেশব্যাপী বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখে। বিশেষত বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ ও গণ-প্রচার মাধ্যমের প্রতিনিধিদের সাথে আমাদের সুসম্পর্ক আছে। এখানকার আহ্‌মদীরা শান্তিকামী, ন্যায়-পরায়ণ, দয়ালু এবং শিক্ষিত শ্রেণী হিসেবে সমাজে সুপরিচিতি।